Dr. Neem on Daraz
Victory Day

১০ বছরেও বিচার পায়নি র‍্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন


আগামী নিউজ | রাজ্জাক সিকদার, ঝালকাঠি প্রতিনিধি  প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২১, ০৮:২২ পিএম
১০ বছরেও বিচার পায়নি র‍্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন

ছবি: আগামী নিউজ

ঝালকাঠি:  ২০১১ সালের ২৩ মার্চ র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধে এক পা হারিয়ে পঙ্গু হন ওই সময়ের কলেজ ছাত্র দরিদ্র পরিবারের সন্তান লিমন হোসেন । লিমনের মা র‌্যাব ৮ এর ৬ সদস্যর বিরুদ্ধে হত্যাচেস্টা মামলা দায়ের করলেও দশ বছরেও বিচার পায়নি লিমন হোসেন ও তার পরিবার। 

১৭ বছরের কিশোর লিমন হোসেন এখন ২৭ বছরের যুবক। পড়াশোনা শেষ করে সে এখন একটি বে- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু দশ বছর অতিবাহিত হলেও তাঁর মায়ের দায়ের করা মামলার কোন বিচার হয়নি। ছয় র‌্যাব সদস্যর বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা চেস্টা মামলাটি এখন পিবিআইর একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার তদন্ত করছে।

লিমনের মায়ের আইনজীবী মো. আককাস সিকদারের সাথে কথা বলে এবং মামলার নথি পর্যবেক্ষনে জানা যায় ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে হতদরিদ্র কলেজছাত্র লিমন হোসেন র‌্যাব সদস্যদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন।

গুলিবিদ্ধ লিমনকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে র‌্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান বাদী হয়ে কলেজ ছাত্র লিমন হোসেন ও স্থানীয় সন্ত্রাসী মোরসেদ জমাদ্দার এবং তার সহযোগীসহ আট জনের নামে দুটি মামলা দায়ের করেন। এর একটি অস্ত্র আইনে এবং অপরটি সরকারিকাজে বাধা দানের অভিযোগে। গুরতর আহত লিমনকে ভর্তি করা হয় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ যথাযথ চিকিৎসার অভাবে লিমনের বাম পা হাটু থেকে কেটে ফেলা হয়। চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় লিমন হোসেন।

এ ঘটনায় লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে বরিশাল র‌্যাব-৮ এর ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে ছেলে লিমনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নুসরাত জাহানের আদালতে একটি নালিশী মামলা দায়ের করেন। আদালতের নিদেশের ১৬ দিন পর ২৬ এপ্রিল ২০১১ রাজাপুর থানায় র‌্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমানসহ ছয়জনের নামে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। অন্য আসামীরা হল কর্পোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল আঃআজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক শ্রী প্রহলাদ চন্দ্র এবং সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাস।

পুলিশ লিমন হত্যা চেস্টা মামলায় ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট র‌্যাব সদস্যদের নির্দোষ উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। লিমনের মা হেনোয়রা বেগম পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট নারাজী দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নারাজী আবেদন খারিজ করে দেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহীদুল ইসলাম।

এ আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ মার্চ ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন লিমনের মা। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচজন জেলা ও দায়রা জজ ২৬ বার রিভিশনের শুনানী গ্রহণ করেন এবং কোন আদেশ না দিয়ে অধিকতর শুনানীর জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করেন। ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট থেকে ০১ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১৬ বার শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল ৪২তম শুনানী শেষে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এসকে. এম তোফায়েল হাসান র‌্যাবের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করেন।

রিভিশন মঞ্জুর হওয়ায় লিমন হত্যাচেস্টায় র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। মামলা নথি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যাওয়ার পর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. সেলিম হাসান লিমন হত্যা চেস্টা মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। আদেশে উল্লেখ করা হয় কমপক্ষে সহকারী পুলিশ সুপার মর্যাদার একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা দিয়ে মামলার তদন্ত করাতে হবে। এই আদেশ নিয়ে নানা জটিলতার পর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআইর (হেডকোয়াটার) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম। গত ফেব্রয়ারি মাসে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং কয়েকজন সাক্ষীর সাথে কথা বলেন। 

সহকারী পুলিশ আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বছর জানুয়ারি মাসে আমি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। ফেব্রুয়ারি মাসে একবার আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কয়েকজন সাক্ষীর সাথে কথা বলেছি। আশা করছি যুক্তি সংগত সময়ের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো। আগামী ২২ এপ্রিল ২০২১ ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লিমনের মায়ের দায়ের করা জিআর ৬৫/১১ মামলায় পুলিশ রিপোর্ট প্রাপ্তির জন্য তারিখ ধার্য্য রয়েছে।

অপর দিকে লিমন সহ আট জনের বিরুদ্ধে র‌্যাব অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধা দানের অভিযোগে যে দুটি মামলা দায়ের করেছিল ওই মামলা  থেকে সরকার লিমনেরে নাম প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩ সালের ১০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব মো. মিজানুর রহমান ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক এবং পাবলিক প্রসিকিউটরকে লিমনের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহারের জন্য আদেশ জারি করেন। এ আদেশ ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ঝালকাঠি জেলা জজ ও চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করা হয়।

পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল মান্নান রসুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঝালকাঠির বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২ এর বিচারক কিরণ শংকর হালদার ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই অস্ত্র মামলার দায় থেকে লিমন হোসেনকে অব্যহতির আদেশ দেন। ঝালকাঠির চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট মো. আবু শামীম আজাদ সরকারের একই সিদ্ধান্তে সরকারি কাজে বাধা দানের মামলা থেকে লিমনকে অব্যহতি দেন ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর। অপরদিকে যে শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরসেদ জমাদ্দারকে ধরতে গিয়ে লিমনকে গুলি করেছিল র‌্যাব সেই মোরসেদ জমাদ্দারসহ অপর সাত আসামী র‌্যাবের দায়ের করা অস্ত্র মামলায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ০৪ আদালত থেকে ২০/০২/২০১৮ তারিখ এবং সরকারি কাজে বাধা দানের মামলায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে গত ২৯/০৩/২০১৮ তারিখ বে-কসুর খালাশ যায়। রিভিশনের শুনানীতে লিমনের মায়ের আইনজীবীরা এ বিষয়টি আদালতে তুলে ধরেন। 

এ দিকে গুলিবিদ্ধ লিমনের একটি পা কেটে ফেলার পরে ২০১১ সালের ৯ মে হাইকোর্ট লিমনের জামিন মঞ্জুর করে। লিমন জামিনে মুক্ত হওয়ার পর লিমনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সাধারণ মানুষ লিমনকে আর্থিক সাহায়তা করে।
ঢাকার সাভারের সিডিডি নামের একটি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান লিমনকে একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেয়। এই নকল পায়ে ভর করে লেখা পড়া করে ২০১৩ সালে লিমন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। 

একই বছর লিমন ডা. জাফরউল্লাহর সহযোগিতায় সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে এলএল.বি অনার্সে ভর্তি হন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে লিমন এলএল.বি অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর লিমন কুস্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম কোর্স শেষ করেন। বর্তমানে লিমন সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। 

মুঠোফোনে লিমন হোসেন বলেন, র‌্যাব আমাকে গুলি করে শুধু পঙ্গুই করেনি, আমাকে সন্ত্রাসী বানানোর জন্য নানা রকম কারসাজি করেছে। রিভিশন মঞ্জুর হওয়ায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে আমার মায়ের দায়ের করা মামলা আবার চালু হয়েছে ঠিকই কিন্তু গত প্রায় তিন বছরেও তদন্তে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। আমি বিশ্বাস করি একদিন র‌্যাবের ওই সদস্যদেরও আদালতে বিচার হবে। পিবিআইর কাছ থেকে ন্যায় বিচার না পেলে আমি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হব। 

লিমনকে প্রথম থেকে আইগনগত সহায়তা দিয়ে আসা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা এ্যাড. আব্দুর রশিদ বলেন, আমরা ঘটনার প্রথম থেকেই লিমনের ন্যায় বিচার প্রাপ্তির জন্য সহায়তা দিয়ে আসছি। প্রথম থেকেই লিমন এবং তার পরিবার রাস্ট্রের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্র ন্যায় বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লিমনের পাশে থাকবে।

লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বলেন, র‌্যাব এবং পুলিশ আমার ছেলেকে সন্ত্রাসী সাজাতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমার ছেলে আইনে পড়াশোনা করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়ে প্রমান করেছে সে সন্ত্রাসী নয় । মৃত্যুর আগে আমার ছেলেকে যারা পঙ্গু করেছে তাদের বিচার দেখে যেতে চাই। 

আগামীনিউজ/মালেক

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে